৮ ডিসেম্বর পলাশবাড়ী হানাদার মুক্ত দিবস

আশরাফুল ইসলাম গাইবান্ধা: ১৬ ডিসেম্বর বাঙ্গালী জাতীর স্বাধীনতা সংগ্রামের চুড়ান্ত বিজয়ের দিন, এদিনটির ৮ দিন আগে হানাদার মুক্ত হয় গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর পলাশবাড়ী বাসীর জন্য একটি স্মরনীয় দিন। কারণ এদিনে পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে এ এলাকা মুক্ত হয়। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের ৯ মাস রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর গাইবান্ধার পলাশবাড়ী বাসী আজকের এ দিনে শক্রমুক্ত হয়ে বিজয় উল্লাস আর “জয় বাংলার ” জয়ধ্বনীতে প্রকম্পিত করে তুলেছিল পলাশবাড়ীর আকাশ বাতাস। এ এলাকা পাক হানাদার মুক্ত করতে অসংখ্য জীবন বলিদান এবং কত অসহায় মা বোনের ইজ্জত লুন্ঠন করেছিল সেই ভয়াবহ দিনে তার সঠিক পরিসংখ্যান কেউ জানে না। এছাড়া পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে এখনও অনেক নারী পুরুষ বেঁচে আছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ কালোরাতে স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষনা হওয়ার পরদিন পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পলাশবাড়ী আক্রমন করে। শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। সে সময় পাকহানাদার বাহিনীর এদেশীয় রাজাকার, আলবদর, পিচ কমিটির সদস্য সেদিন অত্র এলাকার ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে দিয়ে ক্ষতি সাধন করেছিল প্রায় কোটি-কোটি টাকার সম্পদ। সড়ক পথে ভারী অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আসা ৬০ জন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ (ইপিআর) বাহিনীর সাথে বাঙ্গালী সুবেদার আলতাফ হোসেনের নেতৃত্বে শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ব্যবহার হয় মেশিনগান আর কামানসহ বিভিন্ন ভারী সমরাস্ত্র । সারাদিন যুদ্ধে উভয় দলের ২১ জন সৈনিক আত্মহুতি দেয়। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, শহীদ লেঃ রফিক ও আঃ মান্নান। ২৮ মার্চ সকাল থেকেই পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা পলাশবাড়ীতে শুরু করে জ্বালাও পোড়াও অভিযান। তাদের এ অভিযানে মহাসড়কের দুই ধারে গৃধারীপুর, নুনিয়াগাড়ী, জামালপুর, মহেশপুর, বাঁশকাট, নিশ্চিন্তপুর, বৈরীহরিনমারী উদয়সাগর সহ ঐতিহ্যবাহি কালীবাড়ী বাজার আগুনে পুড়ে ছারখার করে দেয়। এখান থেকেই হানাদারদের বর্বরতা, পৈশাচিকতা শুরু হয়। হায়েনারা প্রতিদিন গোটা থানা এলাকায় তান্ডব চালিয়ে নারী-পুরুষ ও যুবক-যুবতীদের ধরে এনে তাদের শক্ত ঘাটি সদরের ডাক বাংলোয় অন্ধকার রুমে রেখে রাতভর ধ্বর্ষনের পর বায়োনোট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে মাটিতে পুতে রাখত। পাষন্ডরা কালীবাড়ী বাজার লুটসহ কয়েকটি গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। সে সময় পাক হানাদার বাহিনীর দোসররা কাশিয়াবাড়ী এলাকার বাসিন্দাদের জোর পূর্বক টেনে হেঁচড়ে একত্রিত করে চতরা-ঘোড়াঘাট সংযোগ স্থলের পশ্চিম রামচন্দ্রপুর গ্রামে সাঁরি করে নৃশংস ভাবে হত্যা করে প্রায় ৩ শতাধিক নারী-পুরুষকে। সেদিন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়, চকবালা গ্রামের সাগের আলী, আমির আলী ও সগুনা গ্রামের আনিছুর রহমান বাদশা । এ সময় লুকিয়ে থাকা নারী-পুরুষদের গগন বিদারী আহজারীতে কাশিয়াবাড়ীর আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। এ নৃশংস হত্যা যঞ্চের করুন কাহিনীর সারসংক্ষেপ সেদিন স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার হয়েছিল। সাগের আলী সেদিনের মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচলেও রামদায়ের কোপে গলায় ক্ষত চিহৃ নিয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বাভাবিক চলাফেরা করতে না পারায় পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পর সাগের আলী মৃত্যু বরণ করেন। হানাদার বাহিনী এদেশীয় দোসর বন্দে আলী খান, মৌলভী হানিফ, রমজান আলী মুন্সিরা শুধু গণ হত্যাই করেনি, এদের কোপানালে সেদিন ধর্ষিত হয়েছিলেন কাশিয়াবাড়ীর ফুলবানু, গিরিবালা, অন্তস্বত্তা হাজেরা বেগম সহ অনেকে। সেদিন একজন পাকিস্তানি ঘাতক সেনা লেঃ রফিকের শরীরের পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালায়। পাবনা জেলার ঐহিত্যবাহী নারিন্দা উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎসময়ের প্রধান শিক্ষক ও গর্বিত গৃহিনী মা ফাতেমা বেগমের বীর সন্তান লেঃ রফিক সেদিন পলাশবাড়ীতে শহীদ হন। সড়ক ও জনপথ বিভাগের ডাক বাংলো ছাড়াও সদরের গৃধারীপুর গ্রামের খাইরুলের দিঘীর পাড়, বৈরী হরিনমারী, সদরের সরকারী মডেল প্রাথমিক স্কুল, ঝাপড় মুংলিশপুর, জামালপুর, উদয়সাগর, কাশিয়াবাড়ী হাইস্কুলের পাশে, পশ্চিম রামচন্দ্রপুর, কলাগাছী ও আমবাগান সহ উপজেলার অনেক স্থানেই গণকবরের স্মৃতি চিহৃ রয়েছে। পলাশবাড়ী থানা এলাকার ৬৫জন বীর সন্তান সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। তম্মেধ্যে গোলাম রব্বানী, আনজু মন্ডল, আঃ লতিফ, আবুল কাসেম, হাসবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক নুরুন্নবী মাষ্টার এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর বাহিনীর ২৬ জন এবং মুজাহিদ বাহিনীর কয়েকজন জওয়ান শহীন হন। ৮ ডিসেম্বর পলাশবাড়ী শক্রু মুক্ত হলে “জয়বাংলা” -“জয় বাংলা” স্লোগানের ধ্বনীতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে যুদ্ধে অংশ গ্রহনকারী অত্র এলাকার হাজার হাজার ছাত্র-যুবক ছাড়াও সর্বস্তরের জনতা আনন্দ- উৎসবের মধ্য দিয়ে নিজ নিজ এলাকায় মায়ের কোলে ফিরে এসেছিল। অনেকেই ফিরে আসেনি। শহীদ হয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। আর এভাবেই সেদিন পলাশবাড়ী উপজেলা এলাকা পাক হানাদার বাহিনীর কবল হতে মুক্ত হয় । উল্লেখ্য, স্বাধীনতার এত বছর পেরিয়ে গেলেও স্বাধীনতার মুলচেতনা কে বিকৃত করেছেন অনেকেই। দেশে জাতিগত ঐক্য খন্ডে খন্ডে বিভক্ত হওয়ায় আজও স্বাধীনতার চেতনা অধরায় রয়ে গেলো। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলে এ অঞ্চলের মানুষের ভ্যাগের উন্নয়ন হয়নি, উন্নত চিকিৎসার জন্য বড় কোন চিকিৎসালয় যেমন গড়ে উঠেনি ও উচ্চ শিক্ষার কোন বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়নি। এমন কি গড়ে উঠেনি কোন ছোট বড় কলকারখানা হয়নি মানুষের কর্মসংস্থান। দরিদ্রতার শিকল হতে ছিন্ন হয়নি এ উপজেলার মানুষ ও জনপদ।

Share, Follow & Subscribe

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *