আগামীকাল ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। বাংলাদেশের বিজয়ের ৫৩ বছর পূর্তি হবে। দিনটি বাঙালি জাতির এক অনন্য গৌরবোজ্জ্বল দিন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দীর্ঘ ২৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের এই দিনে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে বাঙালি জাতি। আসন্ন বিজয় দিবস উপলক্ষে আমি দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করছি জাতীয় চার নেতা, ত্রিশ লাখ শহিদ, সম্ভ্রমহারা দুই লাখ মা-বোন এবং জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিয্যাদ্ধাদের, যাদের মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি সেইসব দেশ ও ব্যক্তিবর্গের প্রতি যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সহায়তা দিয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ১৯৪৮-'৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৬২'র শিক্ষা আন্দোলন, '৬৬'র ছয়-দফা, '৬৯'র এগার দফা ও গণঅভূখ্যানের মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠে। '৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতিকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে দেয়নি। জাতির পিতা অনুধাবন করেন, স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া বাঙালি জাতির ওপর অত্যাচার, নির্যাতন ও বঞ্চনার অবসান হবে না। তাই তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। চলতে থাকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী '৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গণহত্যা চালায়। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার এবং তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীকে পরাজিত করে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেন। আমরা পাই লাল-সবুজের পতাকা। জাতির পিতা মাত্র সাড়ে ৩ বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, রেললাইন, পোর্ট সচল করে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করেন। মাত্র ১০ মাসে তাঁর নির্দেশনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে আমাদের সংবিধান প্রণীত হয়। ১৯৭৫ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ অতিক্রম করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যান। সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন একটি শোষণ-বঞ্চনামুক্ত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক' 'সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে তাঁকে পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার পর থেমে যায় বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। শুরু হয় হত্যা, ক্যু আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। ঘাতক এবং তাদের দোসররা ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করতে জারি করে 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ'। দীর্ঘ ২১ বছর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে জনগণের ভোটে জয়ী হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়। আমরা দায়িত্ব নিয়েই বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি প্রবর্তনের মাধ্যমে গরিব, প্রান্তিক মানুষদের সরকারি ভাতার আওতায় আনা হয়। কৃষি উৎপাদনের ওপর বিশেষ জোর দিয়ে দেশকে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করি। পানির হিস্যা আদায়ে ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি সম্পাদন করি। 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ' বাতিল করে আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম শুরু করি। আওয়ামী লীগ সর্বদা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখে স্বাধীনতার সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করেছে। ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে সরকার গঠন করে গত ১৫ বছর ধরে মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে আসছিল। আমরা জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজগুলো বাস্তবায়ন করে যাচ্ছিলাম। খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছিলাম এবং পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছিলাম। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে বিশাল এলাকার ওপর আমাদের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার। বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ছিটমহলবাসীর দীর্ঘদিনের মানবেতর জীবনের অবসান হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে জাতি গ্লানিমুক্ত হয়েছে। জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত এবং বিচারের রায় কার্যকর করা হয়েছে। আমরা ২০২১-২০৪১ মেয়াদি দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি এবং ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলছিলাম। আমরাই বিশ্বে প্রথম শত বছরের 'ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০' বাস্তবায়ন শুরু করেছিলাম। 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শহর থেকে প্রান্তিক গ্রাম পর্যায়ের ব্যবধান কমিয়ে এনেছি। প্রতিটি গ্রামে শহরের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিলাম। দেশের সকল গৃহহীন-ভূমিহীনের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৯ লাখ ঘর তৈরি করে দেওয়া হচ্ছিল। আমাদের অঙ্গীকার ছিল, দেশে কেউ গৃহহীন-ভূমিহীন থাকবে না। শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা হয়েছিল। মাথাপিছু আয় ২০০৫-০৬ সালের ৫৪৩ মার্কিন ডলার হতে বৃদ্ধি করে ২৮২৪ ডলারে উন্নীত করা হয়েছিল। আমরা দেশের প্রতিটি খাতে অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছিলাম। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, শিল্প ব্যাবসা-বাণিজ্যসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে 'রোল মডেল' হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছিল। আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার ছিল, এই উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রেখে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা। কিন্তু সেই বাংলাদেশ আজ কোথায়? দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশবিরোধী গোষ্ঠী অবৈধ ও অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। ফ্যাসিস্ট ইউনূসের নেতৃত্বে অগণতান্ত্রিক এই গোষ্ঠীর জনগণের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তারা ক্ষমতা দখল করে সকল জনকল্যাণমুখী কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেস্টনীর আওতায় ছিল দেশের প্রায় ৫ কোটি মানুষ। তাদেরকে বিভিন্ন ভাতা প্রদান করা হতো। অধিকাংশ ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। টিসিবির আওতায় ৪৩ লক্ষ পরিবারের ফ্যামিলি কার্ড বাতিল করা হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কষাঘাতে জর্জরিত দেশের মানুষ। ক্ষুধার্ত মানুষ ডাস্টবিন থেকে খাবার তুলে খাচ্ছে। এই সরকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত না হওয়ায় জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে বিষোদগার করা এবং তাদের কণ্ঠরোধ করা। বিপরীতে তারা স্বাধীনতাবিরোধী উগ্র-সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রচ্ছন্নভাবে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। ফ্যাসিস্ট ইউনূসসহ এই সরকারের কর্তাব্যক্তিদের যে মুক্তিযুদ্ধ ও তার ইতিহাসের প্রতি সংবেদনশীলতা নাই সেটা তাদের প্রত্যেকটা পদক্ষেপে প্রমাণিত। রাষ্ট্রীয় আচার থেকে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ দিবস, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত দিবস অর্থাৎ জাতীয় শোক দিবিস, সংবিধান দিবসসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিবস বাতিল করা হয়েছে। 'জয় বাংলা' জাতীয় স্লোগান ঘোষণার রায় স্থগিত করা হয়েছে। প্রগতিশীল আদর্শ এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা সংশ্লিষ্ট যা কিছুতে তারা দায়সারা গোছের আচার পালন করছে সেটা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি দেশের মানুষের নির্ভেজাল অনুরাগের চাপের কারণে। তারা পারলে ভিন্ন বয়ান উপস্থাপন করে জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্র থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চিহ্ন মুছে ফেলত। বাঙালির সম্মিলিত অর্জনের মহান এই গৌরবজ্জ্বল ঘটনাকে গ্লানিতে পরিণত করত। তবে দেশপ্রেমিক জনগণ তাদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে নির্লিপ্ত নয় বরং সোচ্চার হয়েছে, এই হীন পাঁয়তারার বিরুদ্ধে প্রগতিশীল চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসীরা সংগ্রাম চলমান রেখেছে। এর মাধ্যমে বরাবরের ন্যায় প্রমাণিত হয়েছে বাঙালি জাতির সম্মিলিত অর্জন সুমহান স্বাধীনতার মূল্যবোধকে খাটো করার অপতৎপরতা ধূলিসাৎ করা হবে। আর লড়াই, সংগ্রাম ও ধারণের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে সমুজ্জ্বল থাকবে বলে আমি বিশ্বাস রাখি।
জয় বাংলা
জয় বঙ্গবন্ধু
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।